মানব জাতির ইতিহাসে দেখা যায় যে, বিভিন্ন যুগে মানুষ তার বর্ধিত বংশধরের হার ও দুনিয়ার উপকরণাদির পরিমাণ তুলনা করে আশঙ্কা করেছে যে, জনসংখ্যা বিনা বাধায় বাড়তে দিলে তাদের বসবাসের স্থান ও খাদ্যের অভাব দেখা দেবে।
ইংরেজ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস উনিশ শতকের প্রথমভাগে এই তত্ত্ব প্রচার করেন যে খাদ্যশস্যের উৎপাদন যখন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায় তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে ।এই তত্ত্ব অনুসারে স্বাভাবিক নিয়মে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যসংকট এমনকী দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী । এই কারণে ম্যালথাস মনে করতেন যে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য । কিছু বিদ্বজ্জনেরা তাই শূন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সামাজিক লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করেন ।
শূন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্ভব যদি জন্মের হার মৃত্যুর হার সমান হয় । জন্মের হার মৃত্যুর হার সমান হয় যদি প্রতিটি নারী নিজেকে প্রতিস্থাপন করে মেয়ে শিশুর জন্ম দিয়ে। বিশ্বে গড়ে প্রতি 100 মেয়ে শিশুদের জন্য জন্ম হয় 107 ছেলে শিশুর । তাই শূন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি জন্য প্রতিটি 100 নারীকে গড়ে 207 শিশু জন্ম দিতে হবে । অর্থাৎ উর্বরতা হার গড়ে 2.1 প্রয়োজন ।
কিন্তু বাস্তবে ভারতের অধিকাংশ রাজ্য এবং বিশ্বের অধিকাংশ দেশে স্তবতার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার 2.1র নিচে । অর্থাৎ ভারতের অধিকাংশ রাজ্যর এবং বিশ্বের অধিকাংশ দেশের উর্বরতা হার শূন্য জনসংখ্যার বৃদ্ধির উর্বরতা হারের নিচে ।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে, যেসব এলাকায় যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা অন্য বাইরের কারণে নয় বরং প্রাকৃতিক কারণে মানুষের মৃত্যুহার সেখানকার জন্মহারের চেয়ে বেশি, সেখানে ‘প্রাকৃতিকভাবে জনসংখ্যা হ্রাস’ ঘটছে বলে বর্ণনা করা হয়।
জাপানের জনসংখ্যা টানা ৭ম বছরের মতো হ্রাস পেয়েছে। জনসংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৬০ লক্ষের কিছু কম।দেশের আভ্যান্তরিন বিষয়ক মন্ত্রণালয় জনসংখ্যার নতুন চিত্রটি প্রকাশ করে। দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে হচ্ছে ১২ কোটি ৫৮ লক্ষ ৯০ হাজার, আগের বছরের তুলনায় জনসংখ্যা কমে গেছে ২ লক্ষ ৭০ হাজার। ২০০৯ সালে জনসংখ্যা শীর্ষে ওঠার পর থেকে প্রতি বছরই হ্রাস পাচ্ছে। যা ইঙ্গিত করছে দেশে মৃত্যর হার জন্মহারের তুলনায় বেশি রয়েছে। দেশের ১২.৮২ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ বছরের নীচে। ১৫ থেকে ৬৪ বছরের জাপানির হার মোট জনসংখ্যার ৬০.৬ শতাংশ। দু’টি হারই ১৯৯৪ সালের পর থেকে কমে আসছে।অপর দিকে ৬৫ বা তদুর্ধ্ব বয়সীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ২৬.৫৯ শতাংশ।
ইউরোপের এক হাজার ৩৯১টি অঞ্চলের মধ্যে ৫৮ শতাংশ অঞ্চলে জন্মের চেয়ে মৃত্যুর হার বেশি। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের তিন হাজার ১৪১টির মধ্যে ২৮ শতাংশ অঞ্চলের পরিস্থিতি এমন।
ইউরোপের ছয়টি অধিক জনবহুল দেশের মধ্যে তিনটি প্রাকৃতিক হ্রাসের অবস্থায় রয়েছে। রাশিয়া, জার্মানি ও ইতালিতে প্রতি বছর ধরে উল্লেখযোগ্য হারে জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এই তিন দেশের মোট ২৮ কোটি মানুষ বাস করে, যা ইউরোপের মোট জনসংখ্যা ৭৪ কোটি ৩০ লাখের এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
ডেনমার্কে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ভয়ানক ভাবে কমে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে সরকার । জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে নানা কর্মসূচী গ্রহন করলেও তা কোন কাজে আসছে না । গত ২৭ বছরের মাঝে এখন শিশু জন্মহার সবচেয়ে কম। জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে এবার ডেনমার্ক সরকার নতুন কর্মসূচী গ্রহন করেছে ।
সব মিলিয়ে ইউরোপের ১৭টি দেশ প্রাকৃতিক হ্রাসের সম্মুখীন।
জন্মহারের হ্রাসের ফলে জার্মানি ও জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশে এক দশক ধরেই কর্মক্ষম শ্রমিকদের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং আগামীতেও তা আরো কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগামী দশকেই কর্মক্ষম শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি থমকে যাবে ব্রিটেনে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে শ্রম সরবরাহের ওপর।
একটি অর্থনীতির সম্ভাব্য উৎপাদন শ্রমিকদের সংখ্যা ও তাদের উত্পাদন সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে । তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং তার ফলে জন্মহারের হ্রাস দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো নয় ।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রথম পন্থা হচ্ছে, জনগণের ব্যক্তিগত স্বার্থের দোহাই দিয়ে তাদের নিকট জন্ম নিরোধের আবেদন জানানো এবং প্রচার মারফত তাদের মনে এমন একটি অনুভূতি সৃষ্টি করা যেন তারা অধিক সন্তানের জন্ম দিয়ে নিজেদের জীবনযাত্রার মানের অবনতি না ঘটায়। তাদের বুঝতে হবে, যেন তারা নিজেদের আরাম ও স্বাচ্ছন্দের জন্যে এবং সন্তানদের উন্নত ভবিষ্যতের খাতিরে কম সংখ্যক সন্তান জন্মায়।
এভাবেই এ ধরনের মনোভাব আমাদের নৈতিক দিক থেকে দেউলিয়া করে দেবে, আমাদের জনগণকে স্বার্থপর করে তুলবে এবং ত্যাগ, তিতিক্ষা, সমবেদনা ও পরোপকারের প্রেরণা নির্মূল করে দেবে। জনগণের কাছে শুধু যে নতুন সন্তানের জন্মই অসহনীয় মনে হবে তাই নয়, বরং নিজের বুড়ো বাপ-মা ও এতিম ভাই-বোন সবই তার কাছে অসহ্য মনে হবে । যারা নিজেদের সন্তানের বোঝা বইতে পর্যন্ত রাজী নয় তারা কেমন করে এমন সব লোকের বোঝা বইতে রাজী হতে পারে, যারা সন্তানের তুলনায় ভালবাসার সম্পর্কের ক্ষেত্রে অধিকতর দূরে অবস্থান করে।
জন্মনিরোধ আন্দোলনকে স্বার্থকরূপে বাস্তবায়নের জন্যে জন্মনিরোধ সম্পর্কি তথ্যাবলীর অবাধ প্রচার ও এর উপকরণাদি সর্বত্র সহজলভ্য করে দেয়ায় শুধু যে বিবাহিত দম্পত্তিই এইগুলো ব্যবহার করবে তার নিশ্চয়তাকি? প্রকৃতপক্ষে বিবাহিত দম্পত্তির তুলনায় অবিবাহিত বন্ধুযুগলই এ ব্যবস্থা দ্বারা অধিকতর উপকৃত হবে এবং ব্যভিচার প্রসর লাভ করছে ।
নৈতিক অধপতন থেকে রক্ষা করার একটি মাত্র পথই বাকী ছিল অবৈধ গর্ভ সঞ্চারের আশঙ্কা। একবার এ বাধাটুকু অপসারণ করার জন্য বদ স্বভাববিশিষ্ট নারীদের নিশ্চযতা লাভ করেছে যে, গর্ভ সঞ্চারের আশঙ্কা না করেই তারা নিশ্চিন্তে নিজেদেরকে পুরুষ বন্ধুর নিকট দিতে পারবে ।
তাই দেখা যায় যে জন্মনিরোধের জন্য সমাজের ক্ষতি সম্পন্ন হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহমাত্র নেই।